কোভিড-নাইন্টিন রোগনির্ণয়ের সুবিধা-অসুবিধা
মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, ফেলো হিসেবে US FDA তে ৮ বছর কর্মরত ছিলেন, ফ্লোরিডা, ইউএসএ
বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট চিকিৎসক, শিক্ষাগুরু এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যিনি ভারতরত্ন উপাধিলাভ করেছিলেন। কথিত আছে যে, কথোপকথন কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শুধু রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেই তিনি সঠিকভাবে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা করতে পারতেন। বাস্তবে এমনটি খুব কমই ঘটে। সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে রোগনির্ণয় অত্যাবশ্যক, আর সেজন্য পদ্ধতিগত সাক্ষাৎকার ছাড়াও প্রয়োজন হয় শারীরিক পরীক্ষা ও নানান ধরণের ল্যাবোরেটরী টেস্ট-এর। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আর চিকিৎসা পারস্পরিক সম্পর্কিত; ডায়াগনস্টিক মেডিক্যাল ডিভাইসের মাধ্যমে এখন সাধারণ থেকে বিরল রোগ নির্ণয় করে অনতিবিলম্বে চিকিৎসা ব্যবস্থা করা অনেক সহজ হয়েছে। এর ফলে রোগ-ভোগ, জটিলতা সৃষ্টি, হাসপাতালে ভর্তি, অপারেশন ও চিকিৎসা ব্যয় সীমিতকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কোভিড-১৯ রোগ গত তিন মাসে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। রোগ উপসর্গের অনুপস্থিতি কিংবা লক্ষণ রোগভিত্তিক না হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের এ রোগ নিরূপণ করা কঠিন। অথচ এ রোগে এ যাবৎ আক্রান্ত হয়েছে ১৮ লক্ষাধিক মানবসন্তান, আর মাত্র কয়েক মাসে মৃত্যু হয়েছে ১.১ লক্ষাধিক। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অগ্রগামী, শিল্পোন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও কোভিড-১৯ রোগ বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে; এ যাবৎ আক্রান্ত হয়েছে ৫.৩ লক্ষাধিক, আর মৃত্যু হয়েছে ২০.৫ সহস্রাধিক। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিলে শত-সহস্র যোগ হচ্ছে প্রতিদিন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান (Center for Disease Control & Prevention) সিডিসি-র নির্দেশনামতে সন্দেহভাজন সবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ টেস্টিং-এর প্রয়োজন নেই; শুধুমাত্র রাজ্য ও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশ মেনে টেস্টিং সুপারিশ করতে পারেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। সিডিসি’র নির্দেশনা ও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) -এর সাময়িক [ত্বরান্বিত প্রক্রিয়ায়] অনুমোদন-ক্রমে কোভিড-১৯ সনাক্ত করতে কয়েক ডজন নতুন নিউক্লেয়িক এসিড-ভিত্তিক আরটি-পিসিআর ও সেরোলজি্ক্যাল টেস্ট-এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।
আরটি-পিসিআর অ্ত্যাধুনিক মোলিকুলার বায়োলোজী প্রযুক্তি যা থার্মাল সাইক্লার ও ইলেক্ট্রফোরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। শ্বাসতন্ত্র [যেমন নাসাপথ] থেকে সংগৃহিত নমুনা থেকে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সনাক্ত করা সম্ভব। আর সেরোলজি্ক্যাল টেস্ট-এর মাধ্যমে রক্তের জলীয় অংশে উপস্থিত অ্যান্টিবডি (অর্থাৎ, করোনাভাইরাস অ্যান্টিজেন/আমিষের প্রতিরোধী আমিষ) সনাক্ত করা হয়। শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরাই সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও পিসিআর টেস্ট পরিচালনা করতে পারেন। এছাড়া ল্যাবোরেটরির গঠন ও সক্ষমতাও অত্যাবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রে ক্লিনিক্যাল ল্যাবোরেটরির গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক (যেমন, CLIA) Certification -এর মাধ্যমে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব টেস্ট থেকে গুণগত (অর্থাৎ, পযিটিভ বা নেগেটিভ) ফলাফল পাওয়া গেলেও এদের কার্যকারিতা শতভাগ নিশ্চিত নয়। সাধারণভাবে, ইলেক্ট্রফোরেসিস-এর মাধ্যমে সঠিক আকারের ডিএনএ ব্যান্ড দৃশ্যমান হলে তা কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অর্থাৎ টেস্ট পযিটিভ, অন্যথায় তা নেগেটিভ। একইভাবে, রোগীর দেহে পরিমিত পরিমাণে অ্যান্টিবডি (কিংবা করোনাভাইরাস অ্যান্টিজেন) থাকলে এবং যথাযথভাবে পরীক্ষা করলে টেস্ট পযিটিভ হতে পারে, কিন্তু গঠনে মিল থাকায় রক্তে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস না থাকলেও HKU-1, NL-63, OC-43 বা L229E ভাইরাস-এর কারণে টেস্ট পযিটিভ হতে পারে। আবার রোগীর দেহে পরিমিত পরিমাণে অ্যান্টিবডি (কিংবা করোনাভাইরাস অ্যান্টিজেন) না থাকলে তা নেগেটিভ হতে পারে। ত্রূটিপূর্ণ নমুনা সংগ্রহ, তাপমাত্রা-রক্ষায় ব্যর্থতা, নমুনা-মিশ্রণ কিংবা প্রক্রিয়াগত ত্রূটির কারণে বিভ্রান্তিকর ফল পাওয়া যেতে পারে। অতএব, এসব টেস্টের কার্যকারিতা বা সংবেদনশীলতা (সেন্সিটিভিটি) প্রতিষ্ঠিত হতে সত্য/ মিথ্যা পযিটিভ ও নেগেটিভ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে অভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রয়োজন। তুরুটি
করোনাভাইরাস টেস্টের ফলাফল বিচার ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সাধারণভাবে পিসিআর টেস্ট পযিটিভ সংক্রমণ নির্দেশক হলেও অ্যান্টিবডি টেস্ট পযিটিভ চলমান সংক্রমণ নির্দেশক না-ও হতে পারে; বরং তা ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (যা আপেক্ষিক) ইঙ্গিত করে। যেমন, টিউবারকুলিন টেস্ট পযিটিভ হলে সাধারণতঃ তা অতীত যক্ষা সংক্রমণ বা বিসিজি টিকার কার্যকারিতা ইঙ্গিত করে। অপরপক্ষে, করোনা ভাইরাস টেস্টের ফল নেগেটিভ হলে ব্যক্তি রোগমুক্ত কিংবা ঝূকিমুক্ত, এমন দাবী করাও অসঙ্গত। বরং মিথ্যা-নেগেটিভ একজন বাহক মিথ্যা স্বস্তি নিয়ে অন্যদের সান্নিধ্যে এসে অজান্তেই কোভিড-১৯ রোগ বিস্তারে সহায়তা করতে পারেন।
সম্প্রতি জার্মানীর গটিংগেন ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক Lancet ID Journal-এ প্রকাশ করেছেন যে বিশ্ব জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়ালেও এ যাবৎ প্রায় ৬% কোভিড-১৯ রোগ সনাক্ত হয়েছে <https://www.uni-goettingen.de/en/606540.html>। তাদের মতে শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির অভাব, অপর্যাপ্ত কিংবা বিলম্বিত টেস্টিং ইত্যাদি কারণে সারা বিশ্বে ইটালীতে ৩.৫% আর যুক্তরাজ্য, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে <১.২%, <১.৬% ও <১.৭% সনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে আজ নানাবিধ বিড়ম্বনার মুখোমুখি চিকিৎসক ও স্বাস্থসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গ, তারই ইঙ্গিত এ লেখায়। জার্নালটি চিকিতসা গবেষকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হলেও উল্লিখিত রিপোর্ট বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হয়।
তবে আশার কথা, রোগতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, শিগগিরই করোনাভাইরাস সংক্রমণ- তথা মৃত্যুহার কমে যাবে।