করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও প্রতিরোধ

 

গত বছরের শেষভাগে চীনের হুবেই প্রদেশের ঊহান শহরে যে ভাইরাস-সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, ক্রমে তা দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে আজ সারা বিশ্বের ত্রাসে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এর বিস্তার ঘটেছে অন্ততঃ ২০০টি দেশে, আক্রান্ত হয়েছে ১০

লক্ষাধিক মানবসন্তান, আর মাত্র কয়েক মাসে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ সহস্রাধিক; এদের মধ্যে ৩ সহস্রাধিক চীনা, ৩০ সহস্রাধিক ইওরোপীয় আর প্রায় ৬ সহস্র আমেরিকান। এ এক অদৃশ্য শত্রু যা নিয়ন্ত্রনে একরকম ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইওরোপের প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলি।

হাম, জল-বসন্ত, হার্পেস, পোলিও, ফ্লু, হেপাটাইটিস এসব ভাইরাস-জনিত রোগের কথা আমরা কম-বেশি জানি; তবে কোভিড-১৯ রোগ এর মহামারীর কারণে করোনাভাইরাস এখন সবার জানা এক আতঙকের নাম। করোনা অর্থ মুকুট; ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই ভাইরাসকে আমিষ-এর মুকুট-বলয় পরিবেষ্টিত দেখা যায়। করোনাভাইরাস পরিবারের অপর সদস্য সার্স (SARS) ভাইরাস ২০০৩ সালে ২৬ টি দেশে মারাত্মক নিউমোনিয়ার বিস্তার ঘটিয়েছিল; তবে কোভিড-১৯-এর তুলনায় তা ছিল কিছুটা নিয়ন্ত্রনযোগ্য।

অনেকের ধারণায় ভাইরাস অতি ছোট জীব; এ ধারণা ভ্রান্ত। ভাইরাসের কোন দেহ-কোষ বা প্রাণ না থাকলেও আছে আমিষ-বেষ্টিত প্রাণ-সঞ্চালক অনু ডিএনএ অথবা আরএনএ। এরা নিজেরা বংশবিস্তার করেনা, কিন্তু প্রাণী, উদ্ভিদ কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকে, আশ্রয়দাতার জেনেটিক সরঞ্জামের সাথে সংযোজিত হয়ে ক্রমাগত বিভাজিত হতে পারে। একইভাবে অন্যান্য কোষকে আক্রমণ করে এরা পরজীবী ধবংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়।

জীবাণু (microbe) না হলেও আচরণে মিল থাকায় এরা মাইক্রোবায়োলোজীতে অন্তর্ভুক্ত; আর রোগ সংক্রমণ-তত্ত্বও একইভাবে প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত <Biohazard বা জৈব-বিপর্যয়>- চিহ্নটির সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন- এতে পরস্পর-সম্পর্কিত চারটি বৃত্ত আছে; প্রথম তিনটি আশ্রয়দাতা (Host), রোগসূত্র (Agent) ও পরিবেশ (Environment), আর কেন্দ্রে অবস্থিত চতুর্থ বৃত্তটি সংক্রমণ (Infection) নির্দেশ করে। বলাবাহুল্য, আশ্রয়দাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও  রোগসূত্রের রোগসৃষ্টি ক্ষমতার মধ্যে শক্তি পরীক্ষায় পরিবেশ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আশ্রয়দাতা, যেমন মানুষ বা পশু-পাখির দেহে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু থাকে যারা উপকারী কিংবা নিরপেক্ষ, সুস্থ প্রাণী স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাবলে সহজে আক্রান্ত হয় না। কিন্তু রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু আশ্রয়দাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরাস্ত করে তাকে আক্রান্ত করতে পারে। বার্ধক্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদী রোগ, অপুষ্টি, নেশা/মাদকাসক্তি, অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, অ্যান্টিক্যান্সার- জাতীয় ওষুধ  ইত্যাদি আশ্রয়দাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। আবার দূর্বল হলেও রোগসূত্রের সংখ্যাধিক্য শক্তি অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ক্ষতি ও ক্ষত বিবেচনায় তা রোগ লক্ষণ বা উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে, আবার আশ্রয়দাতাকে উপসর্গহীন বাহক (Carrier)-এ পরিণত করতে পারে। বাহকেরা নিজের অজান্তেই রোগ ছড়াতে পারেন। কোভিড-১৯ রোগ নিয়ন্ত্রিত হলেও অতি সম্প্রতি চীনে সহস্রাধিক উপসর্গহীন বাহক সনাক্ত হয়েছে যা দুশ্চিন্তার বিষয় বটে।

কোভিড-১৯ রোগ লক্ষণ বা উপসর্গ হতে পারে শুকনো কাশি, জ্বর, শীতবোধ, শ্বাসকষ্ট, এছাড়া শরীর-ব্যথা, গলাব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি, সাথে স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি লোপ কিংবা পেটের পীড়াও যোগ হতে পারে। ফ্লু বা ঠান্ডা-জ্বরের সাথে উপসর্গে মিল থাকলেও সাধারণতঃ সর্দি বা বদ্ধ নাসাপথ থাকেনা। কিন্তু এসব উপসর্গ রোগভিত্তিক না হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের এ রোগ নিরূপণ করা কঠিন। তাই উপসর্গ দেখা গেলে অবজ্ঞা না করে সতর্কতার সাথে কর্তব্য স্থির করতে হবে।

কোভিড-১৯ রোগের সুনিশ্চিত চিকিৎসা এখনো অজানা; এর প্রতিষেধক টীকাও আবিস্কৃত হয়নি। অত্যাধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতালেই শুধু রোগ জটিলতার চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবাদানকারী সঙ্কট ও অপ্রতুল ভেন্টিলেটর যন্ত্রের কারণে শিল্পোন্নত দেশেও এ রোগে মৃত্যুহার অনেক বেশী। অতএব প্রতিরোধই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। আর সেকারণেই প্রত্যেকে দায়িত্ব-সচেতন হয়ে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশাবলী ও নিজ নিজ দেশের (বা রাজ্যের) সরকারী বিধান মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়।

জৈব-বিপর্যয়-চিহ্ন বা সংক্রমণ-তত্ত্ব অনুসরণ করে আমরা সহজেই বুঝতে পারি- করোনাভাইরাস এক শক্তিধর অদৃশ্য শত্রু; এ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ও অন্যান্য পিপিই ব্যবহার করে এবং বাড়িতে থেকে, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, স্যানিটাইজার/ব্লীচ ব্যবহার করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা আক্রান্ত ব্যক্তি ও বাহকের সান্নিধ্য এড়াতে পারি। সুস্থতা রক্ষায় আমাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত জলপান, বিশ্রাম আর হালকা ব্যায়াম করাও প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ব্যক্তি যেমন চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব স্টাফ এছাড়া যারা বয়স্ক, স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে আছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে তাদের আরো বেশী সতর্ক থাকতে হবে।

মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন
ফ্লোরিডা, ইউএসএ
শিক্ষাঃ এমবিবিএস- বিএসএমএমইউ, ঢাকা; পিএইচডি (মেডিক্যাল মাইক্রোবায়োলোজী) ও স্নাতকোত্তর গবেষণা- নাগাসাকি
ইউনিভার্সিটি, জাপান;
ফেলোশিপ- কেস ওয়েস্টার্ণ রিযার্ভ ইউনিভার্সিটি, ক্লীভল্যান্ড ও ইউএস এফডিএ, সিল্ভার স্প্রিং (যুক্তরাষ্ট্র);
কর্ম অভিজ্ঞতা- স্বাস্থ্যসেবা, মেডিক্যাল প্রোডাক্টস ডেভেলপমেন্ট গবেষণা ও প্রকাশণা, গবেষণা প্রশাসন, রেগুলেটরী রিভিউ, মেডিক্যাল বেসিক সায়েন্স-এ শিক্ষকতা।
বর্তমান অবস্থান- নিউ ইয়র্কে অবস্থিত বহুজাতিক মেডিক্যাল ডিভাইস কোম্পানীতে রেগুলেটরী সায়েন্স প্রফেশনাল হিসাবে কর্মরত।

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *